শেষ নাহি যে….

আমার মাসির একটা হারমোনিয়াম ছিল। তবে মাসি না বলে মাসিদের বলা উচিত, কারণ পর্যায়ক্রমে আমার দুই মাসি ওতে গান শিখেছে মমতাদির কাছে, তারপর আমিও বেলো করে সা-রে-গা-মা তে হাতেখড়ি দিয়েছি। মমতাদি ছিলেন পাড়াতুতো গানের দিদিমণি, মা-মাসিদের অন্যান্য বন্ধুরাও ওনার ছাত্রী ছিল। উনি আসতেন সন্ধ্যাবেলা, আর সাথে নিয়ে আসতেন তবলাবাদক এক মাস্টারমশাইকে। মাসিদের কোলে-কাঁখে বড় হওয়ার জন্যে আমি ওদের সঙ্গীতসাধনার সময়েও পাশে তাল দিতে বসতাম, আর কিছু মনে থাকুক বা না থাকুক, একটা জিনিস স্পষ্ট মনে আছে যে মমতাদি “সারা জীবন দিল আলো” গানটি শিখিয়েছিলেন। পরে কুট্টিমাসি আমাকে সেটা খালি গলায় তুলিয়েছিল, আমি যখন “অফিসিয়ালি” গান শেখা শুরু করলাম, আমার গানের মাস্টারমশাই শ্রীযুক্ত অপূর্ব রায় এই গানটির স্বরলিপি তুলিয়েছেন এবং আমাদের ইস্কুলের প্রার্থনাসঙ্গীতও ছিল এই গানটি।

বারবার এক কথা বললে সত্যি বিতৃষ্ণা জাগে। তার ফলস্বরূপ গানটার প্রতি এবং গানের স্রষ্টার প্রতি তৈরী হয়ে গেল এক অদ্ভূত বিবমিষা। সেই ভাবে দেখলে, রবিঠাকুরের সাথে আমার সম্পর্কটা প্রথম শ্রবনেই প্রেম তো একেবারেই নয়, বরং বস্তাপচা হিন্দি সিনেমার মত প্রথমে বিরক্তি, মাঝে মানভঞ্জন এবং শেষে গিয়ে জমা ক্ষীর প্রেমের মত। শুধু মনে হত ওই বয়েসে, দূর্গাঠাকুর, লক্ষ্মীঠাকুর, কালী ঠাকুরের ছবির পাশে আমাদের পরিবারে শ্মশ্রুগুম্ফযুক্ত আরো একজন ঠাকুরের ছবি দেওয়ালে টাঙানো আছে, তার অলৌকিক শক্তি যাই হোক না কেন, প্রাণপণে ভক্তি করে যেতে হবে, কারণ বাড়ির সকলেই ওনাকে এক লার্জার-দ্যান-লাইফ ঈশ্বরের প্রতিভূ রূপেই মনে করেন।

আর পাঁচটা বঙ্গশিশুর মত “শিশু” আর “শিশু ভোলানাথ”-এর হাত ধরেই আমার ছন্দশিক্ষা। এ ক্ষেত্রে আমাদের ইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী মহোদয়াগণের প্রতি আমার বিশেষ ধন্যবাদ, কেননা মূল পাঠ্যের মধ্যে না রেখে এই দুটি কাব্যগ্রন্থকে “রেপিড রিডার” করেছিলেন, তার ফলে পরীক্ষায় নম্বরের চিন্তা না করে টেনে টেনে “খেলা ভোলা” আর “পুজোর সাজ” মুখস্ত করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এমনকি আমর জীবনের এক এবং একমাত্র সুরারোপ করার অভিজ্ঞতা খেলা ভোলার ওপর নানা সুরের গানের পরীক্ষানিরীক্ষা করে। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় আমাদের রচনা লিখতে দেওয়া হলো “তোমার প্রিয় কবি”। আমার কোনো প্রিয় কবি সেই বয়েসে সত্যি ছিল না, কারণ কেবলমাত্র একজন কবির রচনা পড়ে প্রিয়নির্বাচন করা অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট একটি কাজ এবং কবিদের প্রতি ছিল এক অগাধ শ্রদ্ধা (কখনো ভুলেও ছন্দ মিলিয়ে কিছু লিখতে পারিনি বলে)। যাই হোক, আমার মতামত গ্রাহ্য না করে, মা একটা রচনা লিখে দিল “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।

সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে একটা মজার ব্যাপার ছিল, বক্তব্য থাকুক বা না থাকুক, যে যত বেশি উদ্ধৃতি বা ‘কোটেসন’ ঢোকাতে পারবে রচনায়, তার নাম্বার তত বেশি। বড় সাদা খাতার সারে-তিন পাতা রচনা ছিল, তার মধ্যে ছিল অন্ততঃ দশটা কবিতার উদ্ধৃতি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল-কবিতাটা পড়া নেই, কেবলমাত্র পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্যে ওই চার-পাঁচ লাইন করেই মুখস্ত করা। সেই সাথে বুঝে গেলাম, শুধু “আমার প্রিয় কবি” নয়, যে কোনো বাংলা রচনায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্যে রবীন্দ্রচর্চা ছাড়া সহজ উপায় নেই, কেননা ভদ্রলোক এত বিষয় নিয়ে এতকিছুই লিখে গেছেন যে রচনার শিরোনাম যাই হোক না কেন, ওনার লেখা কোনো না কোনো এক কবিতার কোটেসন নিশ্চই পেয়ে যাব, তা “স্বাক্ষরতার প্রয়োজনীয়তা”-ই হোক বা “খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা”।

ইতিমধ্যে বাড়িতে গানের স্যারও সারা-জীবন-দিল-আলো আর ওরে-গৃহবাসী পার করিয়ে রাগাশ্রয়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত অল্প অল্প করে ঝিনুকে করে খাওয়াতে শুরু করেছেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে গানের কথাগুলোর মানে বোঝার চেষ্টা করেছি একটু একটু করে। তবে একটা ব্যাপারে বলতে দ্বিমত নেই, ছোটবেলা আমার বাবার কাঁড়ি-কাঁড়ি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট শুনে মনে হতো, এমন সহজ বাংলা ভাষা এনারা কেন এরকম কৃত্তিম ভারী গলায় গাইছেন! তবে যে একটা গান আমাকে ওনার ‘ফ্যান’-এ রুপান্তরিত করলো তা আট-ন বছর বয়েসে শেখা “সজনী সজনী রাধিকা লো”। জীবনে গানের জন্যে প্রথম পুরস্কারটিও আসে “মাধবী হঠাত কথা হতে এলো”-র হাত ধরে

ক্লাস সিক্স-এ বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল, তবে রবিন্দ্রপ্রেম-কলাভবন-ছাতিমতলার প্রেমে গদগদ হওয়ার বয়েস তা নয়। শুধু মনে আছে হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে অন্তাক্ষরী খেলেছিলাম, বোলপুরে গাড়ি ঘোড়া না দেখে বেমক্কা রাস্তা পাড় হওয়ার জন্যে মার হাতে উত্তম-মধ্যম খেয়েছিলাম, একটা সাঁওতাল গ্রামে যাওয়ার সময় ধানক্ষেতের আলের ওপর নেচেছিলাম আর শ্রীনিকেতনে গিয়ে হ্যাংলার মতো এটা-ওটা কিনে দেওয়ার জন্যে বায়না করেছিলাম। আজকে সত্যি একটু আফসোস হয়, আসল নোবেলটি দেখার সৌভাগ্য হওয়া সত্তেও তার মূল্য বুঝিনি।

তবে রবিঠাকুরকে প্রথম ডিকোড করা শুরু করেছিলাম অনেক পরে। এই ক্ষত্রে ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ একটি মননশীল বাংলা ধারাবাহিক উপহার দেওয়ার জন্যে, যার ফলে রাবীন্দ্রিক ভাবধারাকে একটু হলেও ভিন্ন সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখবার ইচ্ছা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “প্রথম আলো”-তে জানতে পারলাম কিভাবে এক একটি গানের পেছনে কখনো ভারতীয় মার্গসঙ্গীত, কখনো পল্লীবাংলার মাটির সুর আবার কখনো স্কটিশ মেষপালকের গানের ভূমিকা রয়েছে। তাই বর্তমানে রক-রবীন্দ্রসঙ্গীত ফিউশন করলেই যে গেল-গেল রব ওঠে, তার উত্তরে বোঝা দরকার, আসল মানুষটাই তো সুর এবং কথা নিয়ে এক বিশাল পরিমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গেছেন। প্রানের গান, পাখওয়াজ বাজুক কিংবা গিটার বাজুক এ কথা তো অনস্বীকার্য যে আজও তা সিংহভাগ বাঙালির “চিকেন স্যুপ ফর দ্য সৌল”। প্রেমের মধ্যে পড়া, প্রেমের বাইরে পড়া, পরীক্ষায় প্রথম, পরীক্ষায় ফেল, এসেছে-শরত-হিমের-পরশ, ভগবান-তুমি-যুগে-যুগে যাই ঘটুক না কেন জীবনে, একজন কাব্যস্রষ্টা জীবনের সর্বক্ষণের আবহসঙ্গীত বাজানোর জন্যে সবসময়েই তৈরী যে।

আজকে আর কোনো প্রাসঙ্গিক কোটেসন মনে পড়ছে না। শুধু স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করার জন্যে মাধ্যমিকের বাংলা মৌখিক পরীক্ষার জন্যে যে “দুরন্ত আশা” মুখস্ত করেছিলাম, তার কয়েক পংক্তি লিখতে ইচ্ছা করছে।

“মর্মে যবে মত্ত আশা

সর্পসম ফোঁসে।

অদৃষ্টের বন্ধনেতে

দাপিয়া বৃথা রোষে।।

তখনও ভালোমানুষ সেজে

বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে

মলিন তাস সজোরে ভেজে

খেলিতে হবে কষে।

অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব

জন দশেকে জটলা করি

তক্তপোষে বসে। ”

পুনশ্চঃ ক্লাস নাইনে এক মা চন্ডী আঁকার শিক্ষিকা ছিলেন ইস্কুলে। গরমের ছুটির পর হাতের কাজ করে নিয়ে যেতে হত কিছু। আমার দাদা আমাকে লিনো-কাটিং শিখিয়ে দিয়েছিল। সহজ পাঠের গোপাল করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেইবারও রবিবাবুর কৃপায় ক্লাস থেকে বের হওয়া থেকে বেঁচে যাই।

পুনঃপুনশ্চঃ ধন্যবাদ ভানুসিংহ, আপনার হাত ধরেই আজ ৫০তম ব্লগ লেখা।

About DebaratiK

As one anonymous Quora user said, "You really don't know how much you don't know", I am trying to figure out now how much I don't know, and then would decide on what I should be knowing better than others! If I stumble across something worth knowing to me, I would share that in this blog.
This entry was posted in সং থেকে বং, অনাবাসী ঢং, General stuffs. Bookmark the permalink.

Leave a comment