সব বাঙালের একটা ব্যাপারে চাপা ক্ষোভ আছে, সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। “আপনারা তো সবাই জমিদার ছিলেন” এই জাতীয় মন্তব্য তো গা-সওয়া, তার ওপর তাদের ভাষার উচ্চারণ সেই ১৯৪৭ সাল থেকে অনেক বাজার চলতি বাংলা চলচ্চিত্রে ‘কমিক-রিলিফ’ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সেই ধারা ইদানিং কিছুটা এক ঘেয়ে হয়ে গেলেও মাঝে মাঝেই কিছু ছায়াছবি আর ধারাবাহিকে অপ্রয়োজনীয় ভাবে কোনো এক দুঃসম্পর্কের পিসিমা বা দিদিমাকে টেনে আনা হয় যিনি প্রাণপণে চেষ্টা করে যান বাঙাল ভাষার ব্যর্থ অনুকরণ করতে। প্রকৃত বাঙালদের পক্ষে হীরা এবং কাঁচ আলাদা করে চিনে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় না কারণ এদেশীয়রা বাঙাল ভাষা বলার চেষ্টা করলে শুধুমাত্র প্রত্যেকটি ক্রিয়াপদে অপিনিহিতি ব্যবহার করেন। তাঁরা বোঝেন না এই বঙ্গভূমির স্থানবিশেষে কেবল ক্রিয়াপদ না, বিশেষণ এবং বিশেষ্যেরও রূপ পরিবর্তন হয়।
এতবড় গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ কয়েকদিন পর অপর্ণা সেন পরিচালিত “গয়নার বাক্স” সিনেমাটা দেখলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছে আমি কেন এত অতীত নিয়ে লিখি। আসলে কিছু কিছু বর্তমানের ঘটনা না চাইতেও আঁকশি দিয়ে টেনে টেনে অতীতকে নিয়ে আসে, “গয়নার বাক্স” তেমনই এক অভিজ্ঞতা। দেখে ভালো লাগলো জোর করে পূর্ববঙ্গীয় চরিত্র জোড়াতালি দিয়ে না ঢুকিয়ে এমন একটি গল্প বেছে নিয়েছেন পরিচালক যেখানে মূল ‘প্রটাগনিস্ট’-এর বাঙাল হওয়া ছিল একান্তভাবেই প্রয়োজনীয়। তা না হলে বোঝানো সম্ভব হতো না কেন এককালের জমিদার পরিবারের বংশধরের পক্ষে শাড়ির দোকান দেওয়ার এত কুন্ঠা। বোঝানো সম্ভব হতো না যখন ঝাড়লন্ঠনগুলো একে একে নামিয়ে এনে দেনা শোধ করার জন্য পাওনাদারের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তখন বুকের এক একটা পাঁজর কিভাবে কেঁপে ওঠে। এক একটা মান্তাসা, হাঁসুলিহার, সীতাহার, রত্নচূড় যখন সংসারের ঘানিতে তেল দেওয়ার জন্যে স্যাকরার ট্যাঁকে একবার ঢুকে আর বেরোয় না, তখন একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ গিন্নীটির মনে হয় ফরিদপুরের বাড়িটা থাকলে আজ হয়ত সংসারের এই মুখ দেখতে হতো না।
এপারবাংলার মানুষেরা যতই ওপারের মানুষদের ভাষা নিয়ে হাসি-তামাশা করুন, একটা বিষয় স্বীকার না করে উপায় নেই যে স্বাধীনতোত্তর বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস কিছুতেই ওই পাড়ের বাঙালদের কথা না উল্লেখ না করে সম্ভব নয়। পরিচালককে ধন্যবাদ একটা নিটোল গল্পের ছাঁচে ফেলে দর্শককে সহজভাবে এই ইতিহাসের কিছুটা স্বাদ গ্রহণ করায় আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং তার আনুসঙ্গীক ভিটে-মাটি ছাড়া, বিধবাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নির্যাতন, তত্কালীন জমিদারদের মাছ ধরে কালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে সময় কাটানো, অবশেষে নকশাল আমলের আবির্ভাব এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ – সবকিছুই এসেছে স্বাভাবিক গতিতেই। তাই ধীরে ধীরে গল্পটি আর নিছক গল্প না থেকে হয়ে ওঠে সময়ের আয়না, পূর্ববঙ্গীয় পরিবারের সদস্যদের কাছে সেই আয়না নিজেদের পারিবারিক ইতিহাসটি একবার ঝালিয়ে নেওয়াও, কেননা আমার বয়েসী দর্শকদের অধিকাংশই কঙ্কনা-র চরিত্রটির সাথে তাদের দিদা কিংবা ঠাকুমার মিল খুঁজে পাবে, যিনি ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে না বেরিয়েও শত সংগ্রামের মধ্যে সংসারটাকে দাঁড় করিয়েছেন, আর তাদের কর্মফলস্বরূপ আজ তারা পায়ের ওপর পা তুলে বসে “মুখে মারিতং জগত”।