।।১।।
গ্রীষ্মের দুপুর। যারা ওই নব্বইয়ের দশকেই ছাত্রজীবন শুরু করার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিল, তাদের খুব একটা পড়তে হতো না গরমের ছুটিতে। তাই তিন মেয়েকে ভাত খাইয়ে ঘুমাতে পাঠিয়ে টিভিটা আস্তে করে চালিয়ে দিল মৌলি। খাটে বসতে না বসতেই ও ঘর থেকে হালকা স্বরে নামকীর্তন শুনতে পেল।
“পা রাখ পা রাখ পরপর, দেখি ছোটর পা আমাদের থেকে কতটা ছোট।”
“বড়দি আমাকে আলতা পরিয়ে দিবি আজ বিকালে।”
রিনরিনে গলায় জানালো ছোট। ক্ষোভের কারণটা খুব একটা অযৌক্তিক না, বড় দুজন গতকাল পাড়াতে পৌরসভা থেকে পার্ক-উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত ফাংশানে নেচে বাহবা কুড়িয়ে এসেছে। আর কত্থক নাচের অপরিহার্য অঙ্গ লাল আলতা দেখে ছোটোর একটু ঈর্ষা হওয়াটা অস্বাভাবিক না।
“ঠিক আছে।”
“তোদের কি মজা। তোরা এ-ওর জুতো পড়তে পারিস, আর আমাকে মা তোদের পুরোনোগুলো পড়ায়। এবার স্কুল খুললে আমাকে নতুন কেডস না কিনে দিলে আমি দেখবি কিরকম বায়না করি।”
“ঠিক আছে, মা কে বলিস।”
“তোরাও কিন্তু মাকে বলবি আমার সাথে। নাহলে কিন্তু মাকে বলে দেব একবার তোরা একে অন্যের অঙ্কখাতায় মার সই নকল করেছিস।”
।।২।।
“চুপ চুপ মা আসছে। ঘুমের ভান কর।”
বড়টা বাকি দুটোর মাথার ওপর চাদর টেনে দিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইলো। শোবার ঘরের লাইটটা জ্বেলে মুখ বাড়াল মৌলি। ভুঁরু কুঁচকে একবার ভাবলো, এবার থেকে ছোটটাকে আলাদা ঘরে শোয়াবে। বড় দুটোর ডে স্কুল, কিন্তু ছোটটাকে অনেক ভোরে উঠতে হবে। কিছুক্ষণ আগে ওদের বাবাকে খেতে দেওয়ার সময়েও বড়টার ডমিনেটিং, ছোটটার ইম্পোসিং আর মেজটার পিস-কিপিং গলার আওয়াজ পেয়েছেন। তাই এটা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য না যে এরা এখন অধেক ঘুমে নয়ন চুমে পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
আর আরেকটা কারণও আছে। বড়টার ক্লাস ইলেভেন, মেজটার টেন আর ছোটটার সেভেন। বড়-মেজ এখন যেই মধুমাখা সময়ে পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে আর এই ফলে ও ফলে ঠোক্কর দিচ্ছে, ছোটটাকে ক্লাস সেভেনেই কার্বাইডে পাকানো সেই ফল খাওয়ানোর কোনো দরকার নেই। তবে চেষ্টা করে সফল হয়নি সে এর আগে। দিদিদের সাথে না শুলে নাকি ওনার ঘুম আসে না। আসল কারণ কি আর সে বোঝে না। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের মেয়েদের ক্লাসের পর-নিন্দা-পর-চর্চা নিজের ক্লাসে একটু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে হিরো সাজার চেষ্টা। মেজটার পা টা বেরিয়ে আছে চাদরের তলা থেকে। আলগোছে সেটা টেনে দিয়ে লাইট নিভিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
“ইশ দেখ নেল পালিশটা একদম থেবড়ে গেল চাদরে ঘষা লেগে। মা যে কি করে না!”
মেজ উঠে বসেছে। বড়ও একটু চোখ লেগে আসা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সটান।
“এই কারণেই বলেছিলাম তাড়াতাড়ি খেয়ে নেলপালিশটা লাগাতে যাতে শুতে যাওয়ার আগে শুকিয়ে যায়। এবার বোঝ ঠেলা। নষ্ট করলি তো। এত ছড়াস না সারাক্ষণ!”
“আমাকে তো পড়তে দিলি না রংটা, বেশ হয়েছে। আমি নজর দিয়েছিলাম তাই থেবড়েছে।”
ছোট পাশ থেকে টিপ্পনি কাটলো।
“ইশ উনি পড়বেন নেলপালিশ। আর তুই তো হাতে পরার চেয়েছিলি। এই সেদিন মিসেস মুখার্জীর কাছে ধরা পরে আমাদের হাউস থেকে পয়েন্ট কাটা গেছে তোর নেলপালিশ পরার জন্য। তাও তোর শিক্ষা হলো না।”
বড়-মেজ এবার মাধ্যমিকের ইতিহাসের প্রথম চ্যাপ্টার বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রদর্শনে ব্যস্ত।
।।৩।।
“এই বড়দি, মেজদির পা টা একবার দেখ।”
“মেজ, দাঁড়া। ”
“ঘুম পাচ্ছে, খামকা দাঁড়াতে যাব কেন।”
“পায়ে ওটা কি?”
“কি আবার। মল। জানিস তো ওটা ছোট থেকেই পরি। আজ আবার দেখতে চাইছিস কেন।”
“খুব ভালো করেই জানিস কেন। মলটা মোটেও দেখতে চাইছি না। আংটিটা কোত্থেকে পেলি?”
“গড়িয়াহাট থেকে।”
“মিথ্যা বলার জায়গা পাওনি চাঁদ। তুমি আমার সাথে ক্যাম্পাস থেকে যাতায়াত কর, গড়িয়াহাট কবে গেলে?”
“আরে বড়দি, ও কি একবারও বলেছে নিজে গড়িয়াহাট গেছিল, জিজ্ঞেস করে দেখ মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া কেস কিনা।”
“তার মানে যা শুনছি সব সত্যি। তুই নাকি সোশিও ক্লাস করছিস না একটাও আজকাল?”
“আহ ওটা তো ফালতু। তোর সব নোট নিয়ে নেবো।”
“শুধু তাই? সেদিন সুছন্দা বললো তোকে মেকানিকালের অসীমের সাথে সাউথ সিটিতে দেখেছে।”
“হ্যা মানে, না মানে। আমাদের ক্লাসের সবাই এই সাউথ সিটি নতুন হয়েছে বলে দেখতে ছুটল, আমিও গেলাম, সেখানে দেখা হয়ে গেল আর কি।”
।।৪।।
আজকের রাতটা ঠিক করেছে ওরা গল্প করেই কাটাবে। মা-ও আজ তাড়াতাড়ি শুতে বলেনি। কিরকম একটা পাথরপ্রতিমার মত হয়ে গেছে। কালকে বড়দির ফ্লাইট। সুছন্দাদি আমেদাবাদ যাওয়ার সময় কাকিমা নাকি খুব কেঁদেছিল। ওরা ভেবেছিল মা-ও সেরম কিছু একটা করবে। কিন্তু না, মা নিজেকে কেমন একটা আর্মাডিলোর অতি শক্ত খোলসের মধ্যে পুরে রেখেছে।
“বড়দি তুই কবে আসবি আবার?”
“দেখি, টাকা কিরকম জমে আর গাইড কাজ কিরকম দেয়।”
“নেক্সট টাইম আসার সময় কিন্তু আমার জন্যে একটা ভালো জুতো আনবি। অসীমের দাদা বলেছে, ওদেশে নাকি ব্র্যান্ডেড জিনিস অনেকসময় সস্তায় সেলে পাওয়া যায়। চোখ কান খোলা রাখবি।”
“আর আমার জন্যে লোরিয়ালের নেল পালিশ।”
“আরে আগে গিয়ে তো দেখি! তোরা এমন ভাব করছিস আমি যেন ওখানে শপিং করতে যাচ্ছি শুধু। এখন ঘুমা তো।”
এমনিতে বাদিকে শুয়ে অভ্যস্ত বড় ডানপাশে দেওয়ালের দিকে ফিরলো আজ। না ফিরলে দেখত যেই মেজ-ছোট এতক্ষণ ধরে এটা-ওটা আনার ফিরিস্তি দিয়ে গেল, তারা কানে কানে গুজগুজ করছে, বড়দিকে না বলে ওর সুটকেসে দশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা চার্টপেপারটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা। কোনো এক দুপুরে এই ঘরের মাটিতে বসেই তিনজন একটা কাগজে ডানপায়ের পাতা পাশাপাশি রেখে আউটলাইন করেছিল। সেই বয়েসে তিনটে পায়ের পাতা একটা কাগজে ধরে যেত, আর আজ তিনটে মন একটা সুটকেসে।