ছোট বড় বর্ষা

বর্ষা দুই প্রকার, একটা বাস্তব, একটা রবিঠাকুর। একটা বর্ষায় বুক অব্দি জলে ওয়ার্কআউট করতে করতে এগিয়ে চলতে হয়, আর আরেকটায় মেঘদূত পড়তে হয়। ইস্তিরি করা চুড়ি-পা পরে একটা বর্ষার প্যাঁচপ্যাঁচে কাদার ছিটে লাগলে বিরক্ত হয়ে নাচের ইস্কুলে ঢোকার পর আরেকটা বর্ষার ‘বাদল বাউল বাজায়’-র মহড়া দিতে হয়। কোন বর্ষাটা সত্যি সেটা ঠিক জানি না, তবে দুটো বর্ষাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় লন্ঠনের আলোয় চকচক করা মাছের আঁশে এবং ‘খোকা ইলিশের ডিম হলো না’ আফসোসে।

আমার জীবনের খুব শুরুতে বাস্তবের বর্ষা আমার সাথে একটা ফাটকা খেলা খেলেছিল। তিন বছর বয়েস, আমার মনে থাকার কথা না, মায়ের মুখে শোনা। উত্তর কলকাতার সারদা মিশন ইস্কুলে আমার ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ার ফলে বাবা-মা আমাকে নিয়ে যায়নি। আমার আবার খুব ঠান্ডার ধাঁত, তাই যা থাকে কপালে ভেবে আমাকে আর বাড়ি থেকে বের করা হয়নি। গোখেল ছাড়া আর কোনো ইস্কুলে ইন্টারভিউ দেইনি, এবং পারিপার্শ্বিকতার কৃপায় সেখানেই ভর্তির সুযোগ পেলাম।

স্কোর : বাস্তবের বর্ষা: ০.

ইস্কুলে সেভাবে রেইনি ডে হতো না। ১৪ বছরে মেরেকেটে দু-তিন দিন বৃষ্টির কারণে ইস্কুল কামাই হয়েছে। ছোটবেলা বৃষ্টি পড়লেই নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন:

১. ইস্কুলের কোনো টিচারকে ফোন করা। মিস, আপনি কি আজকে ইস্কুলে যাচ্ছেন?

২. ইস্কুলের অফিসে ফোন করা। ইস্কুল বাস বেরিয়েছে? না বেরোলে আজকে আর যেতে হবে না।

দুটির উত্তর না মিললে:

৩. এমন কোনো মেয়েকে ফোন করা, যার বাড়ি ইস্কুলের কাছাকাছি।

ফলাফল যাই হোক, চল ইস্কুলে। ইউনিফর্ম না, বাড়ির জামা পরে, পায়ে বর্ষা-চটি। ইস্কুলে গিয়ে পোশাক বদলানো। অফ পিরিয়ড অনেকগুলো। তখন ফুল-ফল-নাম-দেশ বা কিলার-ডিটেকটিভ খেলা।

রেনকোট পরতে চাইতাম না। ওতে বর্ষাকে ফাঁকি দেওয়া হয়। স্কোর: বাস্তবের বর্ষা ১.

ক্লাস সেভেন। যারা এলাহাবাদ বোর্ডে গান শিখেছে, তারা জানে দ্বিতীয় বর্ষে দেশ রাগ পাঠক্রমে আছে। বন্দিশটা ছিল, ‘চমক চমক বিজুরিয়া বরসে, পিয়া বিনা অকেলি রহ না যায়ে’। প্রিয় পাঠ্যবিষয়, প্রিয় সিনেমার মত ‘প্রিয় রাগ’ যে হতে পারে দেশ আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। তারপর অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আরো কিছু রাগ শিখলেও দেশের জায়গা কেউ নিতে পারেনি আজ অব্দি। প্রথম এবং শেষ ভালবাসা। যাদবপুরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ইন্ট্রো নেওয়া চলছে চতুর্দিকে। একদিন সেকন্ড ইয়ারের কিছু সিনিয়র ঘিরে ধরল।

এটা ওটা প্রশ্নের পর একটু একটু গান পারি শুনে বলল, ‘একটা গান কর।’

‘আমি কিন্তু শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত জানি।’ কখনও প্রকাশ্যে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাওয়ার সাহস হয়নি।

‘তাই কর’।

সেদিন যে গানটা গেয়েছিলাম, তা হলো, ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’।

কল্পনার বর্ষা আমাকে গান দিয়েছে। স্কোর: বল মাঠের বাইরে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মাধ্যমিকের প্রশ্ন ছিল, ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে সন্তানের দুধ-ভাতের প্রতি বেশী দুর্বলতা থাকার কারণে সেই প্রশ্নটার উত্তর লিখিনি বাড়ি এসে খাচ্ছি, আর আমার মা চোখে চশমারূপী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রশ্নপত্র ঘেঁটে যাচ্ছে। আমার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বাংলায় চিরকালই কাঁচা, মুখস্তবিদ্যা দিয়ে উতরানোর চেষ্টা করেছি, ফেল না করলেই হলো। এমনিতেই তাড়াতাড়ি লিখতে গিয়ে হাতের লেখা খুবই খারাপ হয়ে যেত, যা লিখেছি তা পরীক্ষক বুঝতে পারলেই আমার জীবন বর্তে যাবে।

“এই প্রশ্নটা লিখিসনি কেন।”

“ঈশ্বরী পাটনীর প্রশ্ন ছিল তাই।”

“কিন্তু এই কবিতাটা তো তোর বেশী ভালো পড়া ছিল। এর ব্যাখ্যাটা বল তো?”

বললাম কিছু একটা।

“সেকি, তুই এই পড়েছিস? মনেও তো নেই এটা কি বোঝাচ্ছে।”

ভাগ্যিস লিখিনি। এই ভাবে চোখের সামনে ছোটবেলার ভালবাসার একটা গান খুন হয়ে গেল। ক্লাস ফাইভে ‘কলাপের মতো করিছে বিকাশ’ এই অংশটায় শিখাদি হাত এবং পা টানটান করে যে রাজেন্দ্রাণীর মত স্টেপ তুলিয়েছিলেন, তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল মাধ্যমিকের নাম্বার নামক ছুরিকাঘাতে। স্কোর : কল্পনার বর্ষা: ০.

একাদশ শ্রেণী। সায়েন্সে ভর্তি হয়ে ইতিহাসটা ঘাড় থেকে নামিয়েছি। বাংলাটা এখনও আছে, তবে মনসা পূজার মতো পড়ি। একটা জিনিস ছাড়া। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের চটি বইটা। সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া বাকি অংশগুলো ভালো লাগত না। চর্যাপদের স্তর পার হয়ে গেছে, বড়ু চন্ডিদাসও। এলো বর্ষা, এলো বিদ্যাপতি, ভরা বাদর মাহ ভাদর, এলো সে রাধাকে সম্পূর্ণ করে। রাধা তো আরাধিকা, মানবপ্রেমের নির্যাসটুকু তুলে ধরে তাঁর দয়িতের কাছে।

ছোটবেলায় কদমগাছ একদম ভাল লাগতনা। কদম গাছ বলতেই মনে পড়ত চেয়ারের ওপরে আরো একটা পাটাতন পেতে বসা সেলুনে কাটা কদমছাঁট। না, সব কদমগাছ এক নয়। কিছু কদমগাছ বর্ষা মাখে, স্নেহের পরশ করে যেমত যোগিনী পারা রাধাকে। কালিন্দীরূপী যমুনা নিজেকে উজার করে দেয় কালীয়নাগ দমনকারীর কাছে।

কল্পনার বর্ষা, বইমেলা থেকে কেনা প্রথম বৈষ্ণব পদাবলী। স্কোর দিয়ে ছোট করব না।

যাদবপুরের দ্বিতীয় বর্ষ। সকাল থেকে কয়েক পশলা হয়ে গেছে। রাস্তায় জমা জল। রবীন্দ্রসরোবর মেট্রো স্টেশনে নেমে নীল জিন্স গুটিয়ে নিলাম হাঁটু অব্দি। আনোয়ার শাহ-র মোড়ের পৃথিবীখ্যাত জ্যাম। ইতিমধ্যেই ১১-০-এর ফিজিক্স ক্লাসটায় দেরী হয়ে গেছে। প্যান্টগোটানোটা কি নামাবো? কলকাতায় তখন প্যাডেল-পুশার ক্যাপ্রি খুব ইন ফ্যাসন। টি-২র পাতায় কদিন আগেই একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে এই নিয়ে। হলি-বলি-টলি থেকে শুরু করে যেকোনো পাড়ার কলেজপড়ুয়া, সবাই মেতেছে এই মোহে। ওয়েস্টসাইডে ১০০০টাকা দাম।

ধুত, দরকার নেই। ১০০০টাকা সাশ্রয়। সেই সাথে স্বল্প পরিসরে নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট।

স্কোর: বাস্তবের বর্ষা: ছয় না হলেও, চার।

মাস্টার্স। ফার্স্ট ইয়ারের পরের গরম কাল। গোটা টেক্সাস জুড়েই চলছে দাবানল। খরা। জুলাই মাস মনেহয়। আমার রুমমেট বাড়িতে নেই, অত বড় এপার্টমেন্টে আমি একা। রাত মনেহয় একটা কি দুটো। জানলার কাঁচে শব্দ হলো টুপ করে। একই, বৃষ্টি পড়ছে নাকি।দরজা খুলে বাইরে গেলাম। পাশে আই-৩৫ হাইওয়ে। সনসন করে চলে যাচ্ছে যানবাহন। পাশের প্লেস্কুলটার স্লিপগুলোকে পিছল করে টুপটুপ করে নেমে এলো শ্রাবণ। সেই দিন মনেহয় বছরের একমাত্র বৃষ্টির দিন ছিল। বৃষ্টি এলো, এক ফোঁটা, দু ফোঁটা, তিন ফোঁটা। বৃষ্টি মনে হয় মন পরিষ্কার করে। স্ট্রেস ধোয়। আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে। বাস্তবের বর্ষা: ১

ডাইকোটমি। দ্বিধা। বিভাজন। কোন বর্ষাটা জয়ী? দুজনেই। একজন দিয়েছে ইলিশ ডিম, আর আরেকজন শাড়িতে নূপুর বেঁধে উঠোনে জলকাঁটা ঢেলে পিছল পথে যাওয়ার ড্রেস রিহার্সাল।

 

About DebaratiK

As one anonymous Quora user said, "You really don't know how much you don't know", I am trying to figure out now how much I don't know, and then would decide on what I should be knowing better than others! If I stumble across something worth knowing to me, I would share that in this blog.
This entry was posted in সং থেকে বং, অনাবাসী ঢং. Bookmark the permalink.

1 Response to ছোট বড় বর্ষা

  1. Swagata says:

    khub sundor lkhechis 🙂

Leave a comment