২০০৭ সাল। জুলাই মাস। সেকন্ড ইয়ারের ক্লাস খাতায় কলমে শুরু হলেও পাতায় কলমে শুরু হয়নি, প্রথম সপ্তাহে কোনদিনই ক্লাস হয় না। সেমিস্টারের প্রথম উইকএন্ড। দুপুরবেলা আমার কম্পালসরি ভাত ঘুম পরিত্যাগ করে টিভির সামনে বসে গেছি ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দেখব বলে। এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখা। আমার অত্যন্ত প্রিয় ছায়াছবির একটি। কারণ, ভুলু-তাপসীর প্রেমকাহিনী আমার জীবনের দেখা প্রথম প্রেমকাহিনী। প্রথমবার যখন দেখেছিলাম, তখন প্রেম জিনিসটা কি জানার বয়স হয়নি। মানেটানে অত বুঝিনি। শুধু একটি অতি সুন্দর পুরুষ এবং একটি অতি সুন্দর নারীর পর্দাকাঁপানো স্ক্রিনপ্রেজেন্সের কারণে দিদার পাশে বসে দেখে গেছিলাম।
খুব কম বঙ্গললনা আছেন যারা বোধহয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখটা সুক্ষ্মকোণে রেখে ভুরুর ধনুক বেঁকিয়ে ম্যাডাম সেনের ‘ইন্দ্রধনুউউউউউ’-তে কন্ঠ, তালু, দন্ত, মূর্ধা, অধর কাঁপানোটা অভ্যাস করেননি। মিসেস সেনের লিপস্টিক লাগানোর একটা অদ্ভূত ধরন ছিল। প্রথাগত সৌন্দর্যে না বিশ্বাসী হয়ে মোটা ঠোঁটকে পাতলা না করে বরং বাংলা সিনেমাতে প্রথম জোলি মার্কা বি-স্টাঙ লুক প্রথম মনেহয় উনিই আনয়ন করেন। তবে আমার মূল আকর্ষণ ছিল এই অধর নির্গত সঙ্গীতের ওপর।
“বাবা, ইনি কি নিজেই গান করছেন?”
“না, অন্য একজন।”
তখন মনেহয় ক্লাস ওয়ানে পড়ি। ততদিনে অন্তত জেনে গেছি, সিনেমাতে কথা বলে একজন, কিন্তু গান গায় আরেকজন। শুধু ঠোঁট নাড়ানোটা প্র্যাকটিস করতে হয়।
“কে?”
“সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।”
অভিধানে সংযোজিত হলো এক নতুন নাম। আরো জানতে হবে এনার সম্পর্কে।
তখন দূরদর্শনে সন্ধ্যার দিকে প্রায়ই নানা সঙ্গীত শিল্পীর সাক্ষাতকার এবং গান দেখানো হয়। সাড়ে সাতটার উর্দু খবরের পর ছানা খেয়ে তাকিয়ে আছি টিভির দিকে, হঠাত কোনো একদিন দেখলাম এই কোকিলকন্ঠীর সাক্ষাত্কার। সেই গলা। কিন্তু খানিকটা রসভঙ্গ হলো। কমলিকার যেমন হয়েছিল অরুনেশ্বরকে দেখে, তেমন। একী! ইনি তো একেবারেই সাধারণ দেখতে নিপাট আটপৌরে একজন মহিলা। ইনি এরকম গান? ‘বিউটি বায়াস’ বোধহয় সব শিশুরই থাকে। তাই তারা মনে করে, যা কিছু শ্রেষ্ঠ তাকে সুন্দর হতেই হবে। সেই বায়াস ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে প্রথমে এই মানুষটিকেই কুর্নিশ করতে ইচ্ছা করে।
ক্লাস ৩. আমাদের ইস্কুলের প্ল্যাটিনাম জুবিলী অনুষ্ঠিত হবে। রবীন্দ্রসদনে মর্জিনা-অব্দালাহ দেখে এলাম। একটা গান শুধু মাথায় ঘুরতে লাগলো সারাক্ষণ। ‘আয় বাঁদী তুই বেগম হবি খোয়াব দেখেছি।’ দেরী না করে পরেরদিনই বাবা ক্যাসেটটা কিনে দিল আলিবাবার। দুটো ক্যাসেট, পার্ট ১ আর ২. কদিনেই গানগুলো মুখস্থ হয়ে গেল, এবং সেই সাথে সেল্ফ কম্পোসড কোরিয়গ্রাফি। আরেকবার করে প্রেমে পরলাম সন্ধ্যাদেবীর গলার। এই একটা ক্যাসেটই আমাকে ওনার অন্ধ ভক্তে রুপান্তরিত করে দিল। ভাবতে ভালো লাগে সুন্দর গান কেমন হওয়া উচিত তার প্রথম স্বাদ পেয়েছি এমন কিছু অসামান্য মানুষের কন্ঠ থেকে।
এই বছর একটি সরস্বতীর ছবি এঁকেছিলাম। এতটাই abstract যে লোকজন প্রথমে বুঝতে পারেনি যে ওটা সরস্বতীর ছবি। অনেকে বলেছিল বাউলিনীর ছবি। ক্যাপশন দিয়েছিলাম, ‘স্কিন কালার ডু নট ম্যাটার।’ আমরা কেন মনে করি বীণা পুস্তক রঞ্জিত হস্তে মানেই একজনকে ডাকসাইটে সাদা সুন্দরী হতে হবে? প্রকৃত সরস্বতীরা তো এমন হন না। আমার জীবনের প্রথম সরস্বতী সেই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন।