অতি-সামাজিকতা

গতকাল জ্যাকি কলিন্স মারা গেলেন ৭৭ বছর বয়েসে। যারা এটা পড়ছেন, তাঁরা যদি শ্রীমতী কলিন্সকে না চিনে থাকেন নিজেদের সম্পর্কে অযথা হীনমন্যতার স্বীকার হবেন না, কারণ ট্যাঁশ ইস্কুলের পাকা বাচ্চা ছাড়া কেই বা ওনার হলিউডের পাপারাত্জি নিয়ে মাথা ঘামাবে। যাই হোক, আস্তে আস্তে আইআইটি, আইএসআই, এএইইইই পার হয়ে যখন জয়েন্টের বৈতরণী পেরিয়ে গেলাম তখন ‘ইশ কবে কলেজ যাব’ এই জাতীয় বেয়াড়া চিন্তাভাবনার মধ্যে খুব আমড়াগাছি ভাবে সময় কাটানোর ফাঁকে ফাঁকে কিছু বইয়ের মধ্যে শ্রীমতী কলিন্সের একটি রচনাও পড়ে ফেলেছিলাম। বই ছাড়াও ইস্কুলের বিভিন্ন বন্ধুদের সাথে ফোনে চলত কথোপকথন।

তেমনিই একটি ওলো সই ওলো সই-এর সময় একটি বন্ধু বলে, “এই তুই অর্কুট করিস?”
“সেটা আবার কি?”
“একটা সাইট আছে, সেখানে লোকজনকে স্ক্র্যাপ করতে পারবি।”
“করে করবটা কি?”
“এই এমনি, কন্ট্যাক্ট রাখা।”
চেপে গেলাম তখনকার মত। কম্প্যুটারে হাত যত কম দেওয়া যায় ভালো। আজেবাজে কাজে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না।

কীকরে যেন দেখলাম হট করে সময়টা হঠাত খুব তাড়াতাড়ি কাটা শুরু করলো উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর, এবং সময়ের বেদম ধাক্কায় জয়েন্টের রেজাল্ট দেখা, কাউন্সেলিং এবং ড্যাং ড্যাং করে যাদবপুরের প্রথম দিনের ক্লাসটাও করা হয়ে গেল। একটা চিন্তা মাথায় ঢুকলো, কম্পিউটারটা শিখতে হবে। আমি ইস্কুলে পড়ার সময় কম্পিউটারে হাত দিলেও এই যন্ত্রটিকে ঠিক পছন্দ করতাম না সেই সময়ে, এমনকি একটি ইমেল আইডি তৈরী করতেও ছিল মহা অনীহা। সেই সময় নাগাদই বাড়িতে প্রথম ডেস্কটপটি ঢোকে। কিন্তু ঢুকলে কি হবে, চালাতে তো পারি না, তাই ছুটলাম আমার দিদির বাড়ি। আরো একটা কারণ ছিল, ওর থেকে সি প্রোগ্রামিং নামক ‘এটা খায় না মাখে’ গোছের বিষয় নিয়ে কিঞ্চিত জ্ঞান আরোহণ।

একটি শনিবারের বিকালে আমার দিদির বাড়িতে হাজিরা, জীবনে কখনও প্রোগ্রামিং করিনি আগে, তাই কিকরে এই স্টাডি অফ এনসিয়েন্ট রিউন্স মার্কা বিষয়ে খানিক জ্ঞান আহরণ চললো। শুষ্কং কাষ্ঠং জ্ঞানের মূল্য কীই বা, তাই একটু পরেই ইন্টারনেট কানেকসন চালু হয়ে গেলো। সেদিনই জীবনের প্রথম ইমেল তৈরী করলাম ইয়াহুতে। ঠিক তার পরেই বোধহয় আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। দিদি বলল, “স্বাতী, অর্কুটে একাউন্ট খোল।” এবার আমার উত্তেজনার পারদটা একটু একটু চড়ছে। কৌতুহল বিড়ালকে না মারলেও আমাকে মেরেছিল।

সেই আমার অসামাজিকতার হাতেখড়ি। কিকরে যেন এক মুহুর্তে ‘হুম হোয়াটেভার’ থেকে ‘ওএমজি ইট্স সো মাচ ফান’ এইরকম প্রত্রিক্রিয়ার পরিবর্তন হলো অর্কুট সম্পর্কে এক মুহূর্তেই। এখনকার মত পটাপট সেলফি তোলার ঝোঁক না থাকায় প্রফাইলে ছবি দিলাম কিছু একটা হাবিজাবি। বুঝতে শিখলাম স্ক্র্যাপ কাকে বলে। “ও মাআআ, ইস্কলের কত কে আছে দেখছি! ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই!” বলে ব্যাচের বেশ কিছু মেয়েকে পাঠালাম। তখনও ঠিক সিনিয়রদের রিকোয়েস্ট পাঠাতে সাহস হতো না। এই ভাবে বেশ কিছু সময় নষ্ট করে বাবার তাড়া খেয়ে বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হলাম।

সেই সময় নাগাদই বাড়িতে ডায়াল আপ ইন্টারনেট ঢুকলো। আমাকে দিয়ে প্রায় সরকারী স্ট্যাম্পপেপারে লিখিয়ে নেওয়া হলো, একমাত্র পড়াশোনার কাজ ছাড়া ইন্টারনেট খরচা একদম করব না। কিন্তু ততদিনে আরো একটি হীরের খনির সন্ধান পাওয়া হয়ে গেছে। বাড়িতে না করতে পারলেও বা কি, ডিপার্টমেন্টের পিসি ল্যাব নামক স্বর্গে বেশ ভালোমতো ঠেঁসে ইন্টারনেটে যা ইচ্ছা করা যায়। ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট সেমেস্টারে মঙ্গলবারে খুব একটা ক্লাস থাকত না। সকালে দুই পিরিয়ডের পর বেশ অনেকটা সময় পরে বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ আবার ক্লাস। প্রথম প্রথম সুবোধ বালিকার মত সেন্ট্রাল লাইব্রেরির রিডিং রুমে ঢু মারলেও তারপর থেকে পিসি ল্যাবেই কাটতে লাগলো সময়। অর্কুটের নেশা তখন শুধু আমি না, প্রায় গোটা ব্যাচেই ছড়িয়ে গেছে। নামকেওয়াস্তে দুটো সি প্রোগ্রাম লিখে কাজ করার ভান করি, আর বাকি সময়টা কাটে শুধুই আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা জনগনকে স্ক্য্রাপ করে। জেইউ ইটিসিই গ্রুপটায় জয়েন করা হয়ে গেছে ততদিনে। এমনকি সিনিয়রদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতেও আর আগের মত ভয় লাগে না।

সেই পিসি ল্যাবে একজন স্যার ছিলেন। এচঁড়ে পাকা ফার্স্ট ইয়ারদের এই বাড়াবাড়ি আর দৌরাত্ব ওনার চোখ এড়ায়নি। তেমনি কোনো এক মঙ্গলবারে একটা মেশিনের সামনে জটলা করে ইয়াহু মেইলে আসা কিছু পাইকারী হারে ফরওয়ার্ড নিয়ে অট্টহাস্য চলছে সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে।
এমন সময় সেই স্যারের খুব রাগী গলা, “অনেকদিন ধরে খেয়াল করছি, কিছু ফার্স্ট ইয়ার কোনো ক্লাস না করে সারাদিন চেচামিচি করছে এখানে।”
“না মানে স্যার, আমাদের ক্লাস নেই এখন, তাই….”
“তাই? এখানে এসে হট্টগোল করতে হবে? আসল কাজ ছাড়া যদি আর এই মুখগুলোকে আর একবারও এখানে দেখি….”
কাঁচুমাচু মুখ করে বেরিয়ে এলাম। আহা, স্বর্গ থেকে বিতাড়িত সাপমোচনের মধুশ্রী।

ততদিনে বাড়িতে একটা ছোটখাটো বিপ্লব হয়ে গেছে। ‘পড়াশোনা’-র ফাঁকে ফাঁকে টুকটুক করে অর্কুট খোলার অভ্যাসটাও গজিয়ে গেছে। নভেম্বর মাস নাগাদ আমাদের এক সহপাঠী একটি কম্যুনিটি তৈরী করে, “জেইউ ইটিসিই ফার্স্ট ইয়ার”। মাকে কথাটা বললাম একদিন খেতে খেতে।
“তোদের তো একে অপরের সাথে রোজ দেখা হয়, তাহলে এসবের মানে কি!”
মানেটা বুঝেছিলাম তার চার বছর পর। “জিউ ইটিসিই ফার্স্ট ইয়ার” নাম পরিবর্তন করতে লাগলো বছর বছর। “জেইউ ইটিসিই সেকন্ড ইয়ার”, “জেইউ ইটিসিই থার্ড ইয়ার”, “জেইউ ইটিসিই ফোর্থ ইয়ার”। শেষে সারাজীবনের মত একজায়গায় স্থির হয়ে রইলো, “জেইউ ইটিসিই ২০০৬-২০১০”।

আসল কেত দেখানোর মঞ্চ ছিল অর্কুটে নাম লেখা। পরিবারদত্ত নামটি কেই বা লেখে, তাই একদিন খুব কায়দা মেরে লিখলাম, “শ্যামা তন্বী আমি মেঘ বরনা”। পরেরদিন অচেনা একটি স্ক্র্যাপ, “বাংলা হনার্স?” যদ্দুর মনে পরে, নিজের নামটা কখনই রাখিনি অর্কুটে। ইংরাজি, বাংলা গান, এমনকি ইংরাজি গানের ফরাসী অনুবাদ পর্যন্ত ঠাই পেয়েছে আমার আসল নামটা সরিয়ে। অনেক মহামানব/মহামানবী আবার নিজের নামটি লিখতেন, সাথে একগাদা ~~!!~~**.

থার্ড-ফোর্থ ইয়ার থেকেই বোধহয় আমরা অর্কুট এডিক্ট হয়ে পরি। থার্ড ইয়ার ফার্স্ট সেমে ‘প্রপাগেসন’ নামক একটি মহার্ঘ্য বিষয় গাঁত করতে হতো। পরেরদিন ক্লাস টেস্ট, রাত দশটা-সাড়ে দশটা প্রায় বাজে। দুচোখের সামনে অতিরিক্ত সরিষার পুষ্প দেখার ফলে কোনসেল গুলো প্রায় স্যাচুরেট করে গেছে। ‘চুলোয় যাক সব মায়ের ভোগ’ জাতীয় দুঃসাহসিকতায় রাতে খেয়ে দেয় বসে গেলাম অর্কুট করতে। ৫৫ জনের মধ্যে বাড়িতে ইন্টারনেট আছে কিংবা বাড়ির কাছে সাইবার ক্যাফে আছে, সবাই অনলাইন। পরের দিনের পরীক্ষা ছাড়া সব রকম বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। এই সময় নাগাদ আমাদের একজন ভগবানস্থানীয় ব্যাচমেট এই সময় ওনার দিল্লী ইন্টার্নশিপের কাব্যকাহিনী লিখতে শুরু করেন, এবং গোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সকলে। সেই শিল্পকর্মগুলী উনি ফেসবুকে স্থানান্তরিত করেছেন কিনা জানি না।

ফোর্থইয়ার সেকন্ড সেমেস্টারে অর্কুট আর ফেসবুক দুটো একসাথে করা শুরু হলো। তখন ফেসবুক ব্যবহার করতাম কেবলমাত্র মবওয়ারস খেলতে আর অর্কুটের মাধ্যমেই যাবতীয় কথোপকথন চলত। এই অর্কুটের মাধ্যমেই প্রথম সেই বছর অস্টিনে আশা অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সাথে কিছু আলাপ পরিচয় ঘটে। তবে তখন অর্কুটের মন্দা শুরু হয়ে গেছে, বুঝতে পারছি যাব যাব করছে সেই পুরনো দিনগুলো। আজ হঠাত এতগুলো কথা লিখে ফেললাম, সেই পুরোনো নাম দেওয়ার অভ্যাসের কথাটা মনে হওয়ার ফলে।

ইতি-
মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে।

About DebaratiK

As one anonymous Quora user said, "You really don't know how much you don't know", I am trying to figure out now how much I don't know, and then would decide on what I should be knowing better than others! If I stumble across something worth knowing to me, I would share that in this blog.
This entry was posted in General stuffs. Bookmark the permalink.

Leave a comment