ভালো থেকো ঋতুরাজ

শিরোনামটা ঝেঁপেছি প্রথমেই স্বীকার করি। না, কোনো বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকের লেখা নয়, অনুকরণটা করা অঞ্জলি জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপন থেকে, যেটা ‘প্রতিদিন’-এর চায়ের সাথে টা ‘রোববার’ নামক মাথায়-বড়-বহরে-ছোট পত্রিকাটির মলাটের বাঁ দিকে ছেপে বেরিয়েছিল উনি চলে যাওয়ার পরের সংখ্যায়। এতদিন যাকে দূরের বড়পর্দার নেপথ্যের স্রষ্টানায়ক বলে চিনতাম, একটা সাপ্তাহিকী ছোট চটি-বইয়ের হাত ধরে যে তাঁর সাবলীল কলমের বৈঠায় পৌঁছে যাওয়া যাবে বাঙালীর আটপৌরে জীবনচৌহদ্দীতে, তার মাধ্যমেই ঋতুপর্ণকে দ্বিতীয়বার জানা। পড়ন্ত বিকেলে মুড়ির সাথে আলুর চপ খাওয়া শেষ হলে বাটির কোণ থেকে ছোট ছোট টুকরোগুলো কুড়িয়ে খাওয়ার আনন্দের সাথে সঙ্গত করত ‘রোববার’ পড়া।

আমি তখন বেশ ছোট। বিকেল ৪টের সময় ডিডিতে সিনেমা হতো। সেই প্রাক-কেবেল যুগে এই তিন ঘন্টার জন্যে মা সত্যি হা-পিত্যেশ করে বসে থাকত। মা দুপুরে না-ঘুমিয়ে উঠে বিকেলবেলায় চায়ের কাপ নিয়ে বসত খাটের এককোনায়, আর আমি বাঙালীজন্ম সার্থক করার পরাকাষ্ঠায় উপুড় হয়ে ঘুমাতাম, আর সেই ঘুম ভাঙত খুব কম করে বেলা ৫টা গড়িয়ে যাওয়ার পর। তাই খুব কম বইয়েরই শুরুর আবহসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তখন সিনেমাগুলো ছিল হয়ত উত্তম-সৌমিত্রের সাদাকালো, বা রঞ্জিত মল্লিকের ‘ইন্দ্রজিত’ (কম করে ২৫বার দেখা)। হঠাত দেখি একদিন মা একটা বই দেখছে, কোনো নায়ক নেই সেভাবে, শুধু ‘জানা অজানার পথে ভেসেছি’-র মেয়েটা কালো ফ্রেমের দাদুচশমা পড়েছে আর মায়ের সাথে সারা রাত জেগে গল্প করে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, আমার মাথার ওপর দিয়ে ট্যান খাচ্ছে, কিন্তু মা গোগ্রাসে গলাঃধকরণ করছে সেই বই। পরে বলল, এটা নাকি ‘আর্ট ফিল্ম’ আর এই বইয়ের পরিচালকের নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ।

হবে হয়ত কেউ একটা। কতই তো পরিচালক আছে। কেউ একটা যে নয়, এবং বেশ যে স্বতন্ত্র তার প্রমাণ পাওয়া গেল কেবেল আসার কয়েক দিন পরে, ইটিভি বাংলার ‘এবং ঋতুপর্ণ’ সাক্ষাত্কার অনুষ্ঠানে। অত কঠিন কঠিন কথা বুঝতাম না, ঝাঁকড়া চুলের মেয়েলি কন্ঠের এক পুরুষ শুধু বড় বড় চিত্রতারকাদের ‘তুমি’ সম্বোধন করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে দেখে অবাক লাগত। ততদিনে ‘আঁতেল’ শব্দটা জ্ঞানগন্ডীতে ঢুকে পড়েছে, ঋতুপর্ণ হলেন সেই আঁতেল শ্রেণীর জ্বলন্ত উদাহরণ এবং হলফ করে বলতে পারি সেই বয়েসে ‘আঁতেল‘ শব্দটার মধ্যে কোনো পজিটিভ কনটেসন খুঁজে পেতাম না, খালি মনে হত আঁতেল মাত্রেই দেখনদার হতে হবে। ঋতুপর্ণের বৌদ্ধ্যায়নের মূল্যায়ন করতে না পারলেও সেই ছোট বয়েসে মিডিয়ার দৌলতে তাঁর নারীসুলভ আচার আচরণকে উপহাস করার জন্যে আন্তরিক ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।

বাঙালী চিরকালই তুলনা করতে ভালবাসে, সেই তুলনা কখনো দুই সমকালীন মহারথীর মধ্যে, আবার কখনও বা যোগ্য উত্তরসূরী তৈরী হলো কিনা, সেই নিয়ে প্রশ্ন। তাই সত্যজিত রায়-পরবর্তী যুগযোগ্য চিত্রনির্মানকে কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে নববইয়ের দশকে মননশীল বাংলা ছবিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাটিয়ে কিছু সংখ্যক বাঙালী দর্শককে ফের হলমুখো করার প্রধান কান্ডারী ঋতুপর্ণ। কখনও বা ওনার ছবি চেনা ছক বাঁধা গন্ডীর মধ্যে দর্শককে নতুনভাবে ভাবিয়েছে, আবার কখনও বা ন্যারেসানের চেনা ছক শিকেয় তুলে আমাদের সিনেমা সম্পর্কে পূর্বান্বিত ধারনাটাই ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছেন। “আবহমান” আমার দেখা সেরা ১০টি বিশ্ব-সিনেমার মধ্যে একটি হবে নিঃসন্দেহে। সমান্তরাল একাধিক গল্পের সুতো এমন নিপুণভাবে বোনার ক্ষমতা খুব কম লোকেরই আছে।

আই ফর ডিটেল। যেকোনো মানুষের শিল্পী হয়ে ওঠার প্রধান স্বর্ত। ডিটেলের প্রতি এমন নিপুণ দৃষ্টি এবং অসামান্য ন্যারেটিভ ক্ষমতার গুণে শুধুমাত্র সিনেমা নয়, লেখক হিসাবেও এত মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন ঋতুপর্ণ। কিভাবে সাধারণ ঘটনার মধ্যেও রসের সারাত্সার লুকিয়ে থাকে, সেটা বাঙালী পাঠকের কাছে এক বিশাল পাওনা। উনি চলে যাওয়ার পরে পরে খুব “ঘোষ এন্ড কোম্পানি” দেখতাম, আর দেখতাম একটার পর একটা শব্দ সাজিয়ে কীকরে সুন্দরতায় সাজিয়ে দর্শককে কথা উপহার দেওয়া যায়। সেলেব্রিটি মানেই ‘নোস্-ইন-দ্য-এয়ার’ নয়, তাঁরাও দর্শককে এক ঘন্টার পরিসরে নিজেদের আর্ট সম্পর্কে সমৃদ্ধ করতে পারেন ফুটিয়ে তুলতে পারেন নিজেদের জীবনের অজানা নানা আঙ্গিক, এবং সেটা পারেন অযথা বিতর্কিত সম্পর্ক বা কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ির এদো জলে পা না ডুবিয়ে। শোভা দে-র মতো লেখিকা তথা মুম্বাই সোশালাইটের মধ্যেকার বাঙালী বধূটি আর কোনো সাক্ষাতকারে ফুটে উঠেছে কিনা জানা নেই।

একটা কথা ভাবতেই বেশ রাগ হয়, তখন নেহাত বোঝার বয়েস হয়নি বলে ওনার জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে মস্করা করেছি, কিন্তু কিছু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও কেন ওনার জেন্ডার আইডেন্টিটি পার হয়ে শিল্পীসত্বার মূল্যায়ন করতে পারল না বা করতে চাইল না? একজন মানুষের জৈবিক পরিচয়ের থেকেও তাঁর মানসিক পরিচয় বড় নয় কি? বাঙ্গালীর আই-কিউ কি এতটাই নিঃস্ব হয়ে গেল যে লোকে শুধু মনে রাখল, “ও, উনি তো শুধু বোম্বের নায়িকাদের নিয়ে কাজ করেন”, “ঘোষ-এন্ড-কোম্পানি তো ওই অনুষ্ঠানটা যেখানে মীরকে ঝেরেছিল”, “উনি কি শুধুই ন্যাসনাল আওয়ার্ডের জন্যে কাজ করেন? একটু ট্যান না খাইয়ে সিনেমা বানাতে পারেন না?”, “ধুত, বড্ড ওভারহাইপড, শুধুই সমকামী সম্পর্কের সিনেমা। আর মাথায় পাগড়ি পরে ঢং”। বরং এটা অনেকেই প্রশংসা করলো না যে একজন সেলেব্রিটি তাঁর সেলেব্রিটি স্টেটাসটা ব্যবহার করে দেশের আর পাঁচটা সাধারণ রূপান্তরকামী মানুষকে সঞ্জীবিত করার চেষ্টা করছেন মিডিয়ার সামনে সরাসরি আলোচনা করে। জোর দিয়ে বলছেন মেয়েলী পুরুষ বা পুরুষালী মেয়ে মানেই সে তাঁর দেহের মধ্যে আটকে থাকবে না, তাঁরও অধিকার আছে চিন্তা-চেতনা-ভাবনার সমানাধিকারের।

সত্যি অনেক কিছু দেওয়ার বাকি ছিল। ঋতুপর্ণ ঘোষের হাতে পড়লে মহাভারত কেমন হত মনে হয়েছে বারবার। ওনার না করে ব্যোমকেশ দেখতে পারব না ভেবে খারাপ লেগেছে। হিংসা হয়েছে আমাদের আগের প্রজন্মকে, যাঁরা তাঁদের যৌবনকালে সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণালের বৌদ্ধিক টক্কর দেখেছেন। আমাদের যুগের ঘাত-প্রতিঘাতের ছায়া দেখার পর্দাটা খুবই আগে সরিয়ে নিলেন উপরওয়ালা। সেই দিক থেকে এই প্রজন্ম ব্যাকফুটে। শুধু এটুকু মনে আছে, ঋতুপর্ণ চলে যাওয়ার পর ওনার অবিচুয়ারি দেখতে দেখতে চোখের কোণটা হালকা ভিজেছিল। আর কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির মৃত্যুতে এটা হয়নি কখনই।

পুনঃশ্চ: নতুন করে বাংলায় লেখার অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। মানুষের নশ্বর দেহটাই শেষ হয়ে যায় শুধু।

 

About DebaratiK

As one anonymous Quora user said, "You really don't know how much you don't know", I am trying to figure out now how much I don't know, and then would decide on what I should be knowing better than others! If I stumble across something worth knowing to me, I would share that in this blog.
This entry was posted in সং থেকে বং, অনাবাসী ঢং. Bookmark the permalink.

Leave a comment