ঘড়ির কাঁটা এখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা ছোয়ার জন্য পড়িমরি করে দৌড় লাগাচ্ছে। আমাদের দু প্রজন্ম আগে এই সময়ে তুলসী মঞ্চ থেকে সন্ধ্যারতির শাঁখ বাজতো, এক প্রজন্ম আগে কমলিকা-ছন্দা সেন-দেবরাজ রায়ের কম্বুকন্ঠে দূরদর্শনের সংবাদ বাজতো, আমাদের প্রজন্মের ছোটবেলাতে সন্ধ্যের আরতির শাঁখ বন্ধুর ডাকনামে বাজতো এবং বর্তমানে ‘রাশি তার নাম’ বাজে। ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সিঁড়িটার মাঝামাঝি ল্যান্ডিং-এ পৌছানোর সময় পর্যন্ত আরো একটা (বর্তমানে) কিম্ভুতকিমাকার ঘটনা ঘটতো, তা হলো প্রাত্যহিক থোর-বড়ি-খাড়ার ধারাপাতে ছন্দপতন ঘটিয়ে আগাম সংবাদ না জানিয়ে শিলিগুড়ির রিতাকাকিমা, খড়দার শুক্লামাসী কিংবা গোলপার্কের সাগরিকামাসিদের আগমন।
সাইন-ওয়েভ-এর পিরিয়ডিসিটির মত সব বাড়িতেই কলিং-বেল বাজানোর একটা পিরিয়ডিসিটি থাকে। সকাল ছটায় শিবানীদি রান্না করতে আসবে, সাতটায় খোকনের মা ঘর মুছতে আসবে, তারপর সাত-আট ঘন্টায় বাড়ির সকল-সবল প্রাণীরা বয়েস অনুসারে ইস্কুল-কলেজ-অফিসে বেরিয়ে যাবে, সন্ধ্যাবেলাতে আবার একজন কাজের-লোক বেল বাজিয়ে তার আগমনের ঘোষণা করবে। তাই সন্ধ্যা বেলায় বিদ্রোহী-ব্যতিক্রমী বেল বাজলেই যে “শ্রীপতি সামন্ত” পাঠরত অষ্টম শ্রেণীর বালক/বালিকাটির পড়াশোনায় অর্ধযতিচিহ্ন পড়বে না সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এবং সেই অর্ধযতিচিহ্ন পূর্ণযতিতে রুপান্তরিত হবে যখন মা নিচ থেকে হাঁক পারবে, “দেখ, কে এসেছে!” এবং দেখবে বহুদিন পরে বড়মামা এসে হাসিমুখে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দিচ্ছে মায়ের কাছে।
আমাদের বাড়িতে অনেকেই মা বা বাবার কাছে কাজের সুত্রে আসতো। তাই সব অতিথির আগমনেই তার সামনে হাজির হওয়ার সুযোগ পেতাম না, কিন্তু যদি কোনো আত্মীয় বা মা-বাবার বন্ধু একটি সমবয়সী বাচ্চা নিয়ে আসত, তখন সেই আকস্মিকতার আনন্দে পড়াশোনা তরতরিয়ে উঠলো শিকে। চা, সিংগারা, সময়বিশেষে লুচি, রাত নটা পর্যন্ত চলল সেই আদর আপ্যায়ন। মা-কে পরিশ্রম করতে হবে জেনেও আমি মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছি, আরেক প্রস্থ চা যেন আসে, যাতে আরো একটু খেলতে আর গল্প করতে পারি। সবচেয়ে মজা লাগত যখন দেখতাম কোনো বন্ধুর বন কাঁদতে কাঁদতে আমাদের গেট দিয়ে ঢুকছে (কোনো অলীক বায়না করার নিমিত্ত একটু ওষুধ পড়ার ফলে) কিন্তু বেরোচ্ছে মুক্তোর মতো হাসি ছড়াতে ছড়াতে।
আমাদের একটা পুরনো রেওয়াজ ছিল, ‘বিজয়া’ করা। আমার মার থিওরি অনুসারে বিজয়ার সময়কাল সময় কালিপূজা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং ঠিকঠাক বিজয়া না করলে হয়ত আত্মীয় মধ্যে এক ঘরে হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেবে। তাই দশমী চলে গেলেও খুব একটা চোখের জলে কেঁদে ভাসাইনি কোনদিন, কারণ জানি তারপরেই শুরু হবে রান্নাঘরে বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা। কেউ বাড়িতে বিজয়া করতে এলেই কাঁচের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হবে নাড়ু, খাজা, গজা, তক্তি আর এক পাশে তিনকোনা বাটিতে উপরে হালকা করে পেয়াজ আর লেবুর রস ছড়ানো ঘুগনি। তার প্রসাদ বঞ্ছিত আমিও হব না, প্রতিদান স্বরূপ বয়ঃজ্যেষ্ঠ অতিথিরা চৌকাঠ পেরিয়ে জুতো না খোলা অবস্থাতেই ঢিপ ঢিপ করে দুটো প্রনাম ঠুকতে হবে, এবং উল্টোদিক থেকে শুনতে হবে মাঝে মাঝে, ‘বাবা, আজকাল মেয়ে হয়েও তো ম্যানার্স ঠিক রেখেছ!’
তবে সব সময় যে অতিথি আগমন সুখের হত তা নয়। বিশেষ করে যখন পরীক্ষার সময় কোনো এক অতিথি তার মজার গল্পের ডালি নিয়ে আসতেন এবং মুখ গুঁজে আমাকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের করণাণুসন্ধান করতে হত। শুধু তিনি চলে যাওয়ার সময় মুঘল বাদশাদের ঝরোকা দর্শনের মত মোটে পাঁচ মিনিট তার সাথে বাক্যবিনিময় করার সুযোগ দেওয়া হতো এবং তিনি তার বাড়িতে পরীক্ষার পর আগাম নেমন্তন্ন করে রাখতেন। আবার স্পষ্ট মনে পড়ল, আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখন ভারতের অন্য প্রান্তে থাকা আমার মায়ের এক বন্ধু তার ছেলেকে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল এবং ছেলেটি তিন ঘন্টা জুড়ে তার মায়ের কাছে রোদচশমা কেনার জন্যে বায়না করে গেল ঘ্যান ঘ্যান করে। আবার জীবনে ‘দান-ই মহত ধর্ম’-এর প্রথম শিক্ষা পেয়েছিলাম কিছু অ-তিথিতে আগত গেস্টে (মূলতঃ বয়েসে ছোট) বাচ্চার থেকে, যারা আমার প্রিয় কোনো বই বা খেলনা নেওয়ার জন্যে বায়না জুড়ে দিত এবং ‘আমি তো হোস্ট’ এই অব্যর্থ যুক্ত্যানুসারে সেই মহার্ঘ্য বস্তুটি দেঁতো হাসি হেসে তাদের হস্তে সমর্পণ করতে হতো।
বঙ্গসন্তানদের ‘পর-নিন্দা-পর-চর্চা’ এক জাতীয় ‘হবি’। এক একটি বাঙালীর গল্প-ভান্ডার দেখেই হয়ত মাইকেল লিখেছিলেন, ‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’। সেই রতন অবহেলা করার মত নির্বোধ ছিলাম না, সব সময় ঋণাত্মক ভাবে না দেখে সান্ধ্যকালীন অতিথিদের সাথে বাবা-মায়ের আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই জীবনে প্রথম ‘নেটওয়ার্কিং’-এর শিক্ষা পেয়েছিলাম, বর্তমানে যা নাকি চাকরি এবং কেরিয়ারের উন্নতির জন্য একান্তভাবেই অপরিহার্য। এক মাসির সাথে মায়ের গল্পের মাধ্যমেই প্রথম শিখেছিলাম জয়েন্ট এন্ট্রান্স নামক বস্তুতিটি কি, শঙ্কুদিদি বিয়ের পর কোথায় চলে যাচ্ছে, বালুচরী এবং ইক্কতের পাড়ের তফাত কি, ক্যাম্পাসিং-এ চাকরি পেতে হলে স্পোকেন ইংলিশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ঘটক-স্যারের ছাত্রদের জয়েন্টে সাফল্যের সুক্ষাতিসুক্ষ্ম হার কত ইত্যাদি ইত্যাদি।
তখনও মোবাইল নামক বস্তুটি আসেনি, তাই হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নানা রাগপ্রধান গানের আলাপ-বিলম্বিত-দ্রুত-তানের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে বিরামহীন চলাফেরার এক গল্প থেকে হাজার গোলের কথাশিল্প রচনা করার সময় রসভঙ্গ করে রিংটোন বেজে উঠত না, বা কেউ হওয়াটস্আপ স্ট্যাটাস সেট করার জন্যে হাত বলাতো না ফোন-এ। তাই হঠাত ঘাড় ঘুড়িয়ে সময়সারণী দেখে পিলে চমকে যাওয়ার মত ভাব করে জেম্মা বলত ‘অনেক রাত হলো, এবার আমাকে উঠতেই হবে।’ এই ঘটনার দু-তিন বার পুনরাবৃত্তির পর সত্যই সেই অতিথি উঠে বাইরের গেট পর্যন্ত এগত, কিন্তু বাইরের গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে ‘আজ আসি’ বলার পরেও চলত আরো আধঘন্টার আটকাহন। আমার একটা হাইপোথিসিস, শেষে গেটের ধারে গল্পটা না করলে বাঙালী তার প্রকৃত চরিত্রে উন্নীত হয় না, সেই ধারাবাহিকতা সম্পর্কে আমার ঘরে আগত অতিথিরা আজও হলপ করে বলতে পারবেন।
কিছুক্ষণ আগে আমার এক সহপাঠিনী কক্ষণিকের দর্শন দিয়ে গেল, এবং অবশ্যই আগাম ফেসবুক বার্তার মাধ্যমে তার আসা-যাওয়ার সঠিক কাল নক্ষত্র জানিয়ে। আমাদের পরের প্রজন্ম হয়ত আর বুঝবেও না অপ্রত্যাশিত কলিংবেল শুনে দরজা খুলে ভীষণ ভাবে প্রত্যাশিত কারোর হাসিমুখ দেখার অনাবিল আনন্দ। আমরাও হয়ত এবার থেকে ফেসবুক ইভেন্ট তৈরী (অবশ্যই নির্দিষ্ট নির্ঘন্ট অনুসারে) করে আর-এস-ভি-পি করে একে অপরের বাড়ি যাব, যাতে খাবারের অযথা অপচয় না হয় এবং গুগেল স্প্রেডশিটের মাধ্যমে পটলাকের (আমরিকি দেশে এসে দেখা এমন এক সামাজিক অনুষ্ঠান যেখানে এক একজন অতিথি এক একটি পদ রান্না করে নিয়ে আসেন) আয়োজন হবে যাতে একাধিকজন একই পদ রান্না না করে নিয়ে আসেন। বাঙালি ভুলে যাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরে ম্যানেজ করে কিকরে আক্ষরিক অর্থেই অতিথির সাথে নানা আঙ্গিকের গল্প করতে হয়। কেউ খবর না দিয়ে এসে পরা মুর্শিদাবাদের ন’কাকিমার জন্য কাঞ্জিভরম শাড়ী পরা অবস্থাতেই লুচি ভাজার জন্যে আড়ালে স্বামীকে ডেকে বলবে না, তুমি টিন্কিকে নিয়ে রিন্কির জন্মদিনে চলে যাও, আমি যাব না। কেউ আর পাড়ার মিষ্টির দোকানে গিয়ে বলবে না, ‘ওরে সজল চটপট দশটা সিংগারা ভাজ দেখি, আমার শালী দুই ছেলেকে নিয়ে এসেছে!’
পুনশ্চঃ “বাবা বললো বাবা বাড়ি নেই”। কোন প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে তা আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না।